December 02, 2008

ব্যস্ত দিনের কথাঃ২

সকাল ৭টা থেকে দিনের শুরু। কিন্তু ঘুম দেবী চোখের পাতা থেকে বিদায় নিতে প্রতিদিন ই যথেষ্ট দেরী করেন, ফল স্বরূপ ক্লাসেও মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে থাকতে হয়। অবশ্য ঘুমের দেবী কখনো সখনো দয়াপরবশত হয়ে তারাতারি বিদায় নিয়ে দিন গুলোকে একটু আলাদা করে দিয়ে যান। সকালের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে পদব্রজে যাত্রা সেইদিন গুলোর প্রথম কাজ। ঢাকা শহরের অতিবিলাসী এলাকার রাস্তা ধরে, বিলাসী মানুষগুলোর ব্যস্তসমস্ত হয়ে গাড়ি হাকিয়ে চলা আর ওর মধ্যে বসে থাকা তাদের সন্তানদের ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে স্কুলে যাওয়া দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌছানো। এর মাঝেও কিছু কিছু ব্যতিক্রম ব্যাপার দৃষ্টি সীমানায় আটকে যায়, মনে গেঁথে যায়। রাস্তার পাশে খেটে খাওয়া মানুষ, মেট্রোপলিটনের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের ধুলোবালির রাস্তা গুলোকে পরিষ্কার রাখার বৃথা চেষ্টা, আর কর্মব্যস্ত মানুষগুলোর ছুটে চলার শুরু। ঠিক এইভাবেই দিনের শুরুর কোনো কোনো সময় একটা মানুষের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। কখনো পদব্রজে, কখনো রিকশায়। দেখলেই বুঝাযায় একটা সময় দেখতে খুব ফর্সা না হলেও, আকর্ষনীয় ছিল। বেশ কয়েকবার তার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে, এবং ততবারেই আমি তার চোখে কি যেন একটা দেখতে পাই। এসিডের ভয়ঙ্কর ছোবলে তার মুখটা নষ্ট হয়ে গেলেও, চোখে তেজটাকে কমাতে পারেনি মোটেও। বরং সেটাকে যেন বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকগুনে। আয়নায় যখন নিজের মুখটা দেখি তখনি আমি ওই মুখটা কল্পনা করে ভয়ে, কষ্টে আতঁকে উঠি।

দুপুরে ফেরার পথে, রাস্তার পাশের বস্তির ছেলেমেয়েদের ছুটাছুটি দেখলে শ্রীকান্ত যেন গেয়ে উঠে, “……..আমার ভেতরে ছোট্ট ছেলেটা আজও তো বড় হচ্ছে, তাই আমার বয়েস জানে বাড়লে বয়েস ছোট্ট হবার মানে”। মাঝে মাঝে চোখ চলে যায়, অফিসার্স কোয়াটারের বাসা গুলোর জানালার কার্নিশে রাখা আচারের বোতলে। সুর্য্যি মামার প্রচন্ড উত্তাপে হঠাৎ বয়ে যাওয়া এক পশলা হওয়া চুল গুলোকে এলোমেলো করে দেয় না, মনটাকেও যেন কোথাও নিয়ে যায়। পদক্ষেপগুলো যেন এলোমেলো হয়ে যাবার বৃথা চেষ্টা। কোন কোনদিন বিকালে ফেরার পথে রবি মশাই এর গান বেজে উঠে, “এই ঊদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুল গুলি ঝরে……….”। আনমনা হয়ে হাটতে হাটতে মনে হলো কেউ যেন পাশাপাশি হাটছে। এক্ষুনি বলবে, দাও দেখি ব্যাগটা। মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি। হয়ত হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতির টানে হাতে হাত রেখে হারিয়ে যাওয়ার সুপ্ত বাসনায় মেতে উঠতে চায়। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ীর হর্ণে স্বম্বিত ফিরে পেয়ে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবার কষ্টে মন খারাপ করা। এইভাবেই সমাপ্তি ঘটে কোন কোন কর্মব্যস্ত দিনের। সন্ধ্যাগুলো যেন নিজের রঙ্গে রঙ্গিন। সারাদিনের ক্লান্তিতে যখন বিশ্রাম চাইছে তখন শুরু ক্রতে হচ্ছে নতুন আরো একটি দিনের প্রস্তুতি। অথবা সবাই মিলে কোন একটা ভুতের movie দেখে অকারনে চিৎকার করে উঠা, নয়ত হাসির কোন movie/ জোকস্ শুনে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে যাওয়া। কখন, কিছু ভাবনাকে শব্দের জালে ফেলার চেষ্টা। তারপর ক্লান্ত শরীরকে গভীর রাতে বিছানার হাতে সঁপে দেয়া। সকালে আবার হয়ত কোন একটা ভাল অথবা কারো প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা শুনে হাল্কা একটা চাপা কষ্ট নিয়ে খবর নিয়ে দিন শুরু করা। আরো একটি দিনের শুরু, নতুন এক দিন, নতুন করে।

ক্লাস, লেকচার, আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, বিতর্ক এরকম আর কিছু কাজের মাঝেই দিন পার হয়ে যায়, পার হয় বছর। এক একটা সেমিষ্টার শেষ হয়ে যায়। এই ত আর মাত্র কিছুদিন, তারপরেই ছুটি। যদি জিজ্ঞেস করে কেমন গেল গত তিনটি মাস? এককথায় বলব খুব খারাপ। টানা ৪২ দিন কোন ছুটি ছাড়া এমনকি সাপ্তহিক ছুটিগুলো ছাড়া ক্লাস করে এখন আমি ক্লান্ত, অবসন্ন। এর মাঝেও কি করেছি বলতে গেলে বলব তেমন কিছুই করিনি। IC, Electrical এর সার্কিটগুলোর সাথে বন্ধুত্বটাও এবার ভাল জমেনি। ফেইসবুকের গ্রুপ এর কাজ ও যে খুব হয়েছে তাও নয়। জীবনের টানাপড়েন, মান অভিমান, হলের বিভিন্ন সমস্যা, আনন্দ-বেদনা এই গুলোর মাঝে কেমন করে যেন এই সময় গুলু চলে গেল !! এর মাঝে পাওয়া কি?? কিছু বন্ধুত্ব, কারো মুখোশ উন্মোচন, কারো বিশ্বাসঘাতকতা, অস্থিরতা, কারো নিবেদন, চোখের সামনে ঘটে চলা নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা, আরো রক্তের বন্যা এইতো। বছরটা শুরু হয়েছিল আগের বছরের কিছু পাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। আর শেষ করব?? আরো ৩০ দিন বাকি, দেখা যাক কি আছে সামনের দিন গুলোতে।

গত সেমিষ্টারের শেষের দিনে লিখে ছিলাম একটা কবিতা তাও আবার সারারাত হৈহল্লা করার পরে ভোরের প্রথম আলোতে। এইবার?? এইবার কি লিখব?? জানি না। এই ইট কাঠের ব্যস্ত শহরে এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আজ পরীক্ষা শেষে অনেকক্ষন ঘুরেছি, একটু প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম, পারলাম না। তাই এই যন্ত্রের শহরকে কিছু দিনের জন্যে বিদায় জানাবো, পালাবো!! তাই, এইবার বিশেষ করে সেমিষ্টারের শেষের দিনে কিছুই করা হবে না। সবাই আমরা ভীষন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তাই যদি বলি আমরা সবাই পালানোর জন্যে তৈরী হচ্ছি ভুল বলা হবে না।