June 14, 2009

ফেরা-২

(২)
হাল্কা নীল রঙের আলো ঘরটাকে কেমন যেন অদ্ভুত করে রেখেছে। নীলাভ কিন্তু কেমন যেন স্বর্গীয় একটা ভাব আছে। ঘরে জিনিস বলতে একটা খাট, একটা টেবিল আর একটা মানুষের থাকবার জন্যে যা প্রয়োজন তাই।

টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে, ল্যাপটপটাও খোলা। ফ্যানের বাতাসে কাগজ গুলো উড়ে যাবার চেষ্টায় রত। কিন্তু টেবিলের সামনে যে চেয়ারটা, সেটা খালি পরে আছে। কেউ যেন একটু আগেই বসেছিল ওখানে। ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার পর্দা বাতাসে উড়ছে, হয়ত বৃষ্টি আসবে। রাত যখন খুব গভীর হয় তখন এই বাতাস যেন মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়!

আবছা অন্ধকারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেকে দেখে বিজনের খুব কষ্ট হলো। হাল্কা পায়ে হেঁটে সুমনের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো বিজন।

বাবার এই আসার জন্যে সুমন যেন প্রস্তুত ছিল, ঠিক তেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনি রইল সে। দুজনকেই যেন রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে রাখলো কিছুক্ষন। সেটাকে ভাংগলো বিজন।
- কেমন আছিস খোকা?
- ভাল আছি বাবা। তুমি কেমন আছ?
- যেমন দেখছিস ঠিক তেমন আছি। বলেই রেলিং এ থাকা ছেলের হাতের উপরে হাত রাখে বিজন। আচ্ছা তোর জয়েনিং কবে? কিছু খবর পেয়েছিস?
- এই তো আগামী মাসেই জয়েন করব। স্যাররা বলেছেন কয়েকদিনের মধ্যেই চিঠি পাঠাবেন। তোমার কেমন চলছে সব?
- হুম্ম ভাল চলছে। অফিসে নতুন কিছু ইঞ্জিনিয়ার জয়েন করেছে। তোর ব্যাচম্যাট আছে একজন। ইল্যাকক্ট্রিকাল থেকে পাশ করেছে বুয়েট থেকে। আমাকে দেখেই প্রথম দিন খুব খুশি। কি যেন ছেলেটার নাম। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে রকিব। চিনিস নাকি?
- হুম্ম চিনি। আমাকে ফোন করেছিল।
- তোর ফিউচার প্ল্যান কি? কিছু ঠিক করেছিস?
- বাবা, আমি ভাবছিলাম এম. এস. টা করেই ফেলব কিন্তু আর কয়েকদিন পরে। এখনি নাহ।
- এই কটা’দিন কি করবি তাহলে? কোথাও থেকে ঘুরে আয়।
- ভাবছি, সব বন্ধুরা মিলে বের হব। তাই কাল সবাই এক সাথে হব।
- সেই ভাল। আচ্ছা কিছু হয়েছে তোর?

কিছুক্ষন চুপ থেকে সুমন বলল, বাবা দিন সব সময় কি আর ভাল যায়? তুমি আমার খুব ভাল একজন বন্ধু কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু কথা ঠিক মনে থেকে বের হতে চায় না। মনে হয় যত মনে থাকবে ততই ভাল। কিছু কথা থাক না মনের মাঝে। কি এমন ক্ষতি তাতে?

ঠিক আছে সে না হয় মানলাম। কিন্তু বন্ধু বলে কাছে টেনে নিয়ে আবার কেন দূরে সরিয়ে নিচ্ছিস নিজেকে? কোন সমস্যা থাকলে বল। কথা বলতে বলতে দুজনই এসে ঘরে ঢুকল। বিজনকে চেয়ারে বসিয়ে সুমন নিচে ফোমের উপরে বসল।

বাবা কিছু থাকে, থেকে যায়। কিছু কিছু থেকে যাওয়া কি ভাল নয়?সুমন মাথা নিচু করে কথা গুলো বলল।
তাই বলে একটা ছোট্ট ব্যাপায় নিয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলবি? একটা জিনিস আমি তোর সম্পর্কে জানি তুই কখনো ছোট ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাস না। কিন্তু আজ মনে হল কিছু আছে ওই কার্ডে।

বাবা, আমি জানি তুমি খুব চিন্তা করছো কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। হঠাৎ করেই কেন জানি মেজাজ খারাপ হয়ে গেল! বলেই সুমন আবার মাথা নিচু করল আর সে অবস্থাতেই বলল, বাবা I am sorry।

ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিজন। ছেলেটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে, কিছু একটা আছে যা সে বলতে চাচ্ছে না। বিজন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সুমনের মাথায় হাত রেখে বলল, কিছু না হলেই ভাল। তুই ও ভাল থাকিস আমরাও ভাল থাকি। তবে কি জানিস চাপা ক্ষোভ আর কষ্ট মানুষকে কষ্ট দেয়। সব কাজের পিছনেই কোন না কোন কারন থাকে। ভাল থাকে, মন্দ থাকে। তবে তোর নিজের কাজে যেন তোর সামনের মানুষটা কষ্ট না পায় সেদিকে একটু খেয়াল রাখিস। অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়। একটানে কথা গুলো বলে বিজন ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে পিছনে ফিরে তাকাল।
সুমন তখনো ঠিক তেমন ভাবেই বসে আছে। দেখে বিজনের কেন যেন খুব কষ্ট হল।

সুমন এভাবে কতক্ষন বসে ছিল নিজেও জানে না।
কি করছিলাম আমি? কার কথা ভাবছিলাম? নিজের মনে মনেই কথা বলে সুমন। আমি কি করে পারি চৈতির কথা চিন্তা করতে? আমি কি সেটার যোগ্য? কেনই বা ভাবছি?
বৃষ্টি পড়ছে। গা ঝেড়ে উঠে ঘরের দরজাটা এলিয়ে দিয়ে চেয়ারটায় প্রথমে হেলান দিয়ে বসল, একটু পরে সোজা হয়ে বসল। instrumental মিউজিক আস্তে সাঊন্ড দিয়ে ছেড়ে দিয়ে ল্যাপটপের কী-বোর্ডের দিকে হাতের আঙ্গুল গুলো চলে গেল। Google এর search box এ যেন আচ্ছন্নের মত লিখে ফেলল, Chaity Chowdhury. তারপরে এন্টার কী চেপে দিল।
(চলবে)

No comments: